পাশ্চাত্য এবং আমরা:বুনিয়াদি তফাৎ
- খালিদ মুহাম্মাদ সাইফুল্লাহ
- Aug 10, 2022
- 7 min read
শুরুর কথা:
বিগত তিন শতকে অধিকাংশ মুসলিম দেশ ইউরোপীয় উপনিবেশের প্রভাববলয়ে ঢুকে গিয়েছিল। এ সময়ে সামাজিক, অর্থনৈতিক, মতাদর্শিক এবং রাজনৈতিক মতামতের ভিন্নতা সত্ত্বেও উপনিবেশিত মুসলিম জনগোষ্ঠীর মুক্তি-সংগ্রামের লড়াইয়ে ইসলাম তাৎপর্যপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছে। নানাবিদ বৈচিত্র্য সত্ত্বেও মুসলিম দেশসমূহে বেশকিছু সাদৃশ্য ছিল, তারমধ্যে ইসলাম সবচে সুস্পষ্ট; স্রেফ ধর্ম বা বিশ্বাস হিসেবে না, বরং সামাজিক, রাজনৈতিক আত্ম-পরিচয়ের উৎস হিসেবেও ইসলাম সবসময় হাজির ছিল। উপনিবেশের যুপকাষ্ঠেও নিজেদের সংষ্কৃতি বাচানোর তাগিদ ছিল। এ কারণে একমাত্র তুরষ্ক ছাড়া ‘ধর্মনিরপেক্ষ জাতিয়তাবাদ’ মুসলিম বিশ্বের রাজনীতিকে সম্পূর্ণরুপে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয় নি।
শব্দগুচ্ছ:
সভ্যতা-সংষ্কৃতি, আসাবিয়াত, রুহানিয়াত, আধুনিকতা, উত্তরাধুনিকতা, গির্জা, গ্রিক-ফিলোসফি, বর্ণবাদ, গণতান্ত্রিক অধিকার, লিবারেলিজম, পুজিবাদ, সামন্ততন্ত্র, দ্বান্দিকতা, সাংষ্কৃতিক বিচ্ছিন্নতা।
সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রাথমিক আলাপ:
সভ্যতা ও সংস্কৃতি নিয়ে যে আলাপগুলো সাধারণত হয় তার প্রায় সব ডিসকোর্সেই প্রত্যয় দুটির তাৎপর্য নিয়ে বহুমাত্রিক বয়ান আছে। এজন্য বোঝার সুবিধার্থে ভূমিকামূলক কিছু নোক্তা উল্লেখ করব প্রথমতঃ সংষ্কৃতি (culture) এবং সভ্যতা (civilization) নিয়ে পশ্চিমে বিগত কয়েক শতকের বিতর্কে এমন দুজন পন্ডিতকে পাবেন না, যারা ঐক্যমতে পৌঁছতে পেরেছেন (১)। অনেকে সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে অভিন্ন অর্থে ব্যবহার করে এ সংক্রান্ত আলাপের জটিলতা ও সমস্যাকে আরও তীব্রতর করেছেন। ফলত প্রত্যয়গুলোকে ডিফাইন করার চেষ্টা না করে, তার চরিত্র ও ভাবাবেগকে বিশ্লেষণের ভেতর দিয়ে বোঝাপড়া করতে চেষ্টা করবো।
দ্বিতীয়তঃ ইবনে খালদুন মানুষের সঙ্গবদ্ধতা এবং স্থায়িত্বের সুত্র থেকে সমাজের উৎস নির্মাণ করেছেন। বিচ্ছিন্নতা সমাজ জীবনে কি ধরনের সংকট ও সমস্যার সৃষ্টি করে এবং মানুষের জানমালকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয় ইবনে খালদুন সেগুলো তুলে ধরেন, অতপর সেখান থেকে রাষ্ট্র, নেতা এবং সুসংহত নিয়মাবদ্ধতার জরুরত তুলে ধরেন, যা পারস্পরিক শত্রুতা, বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যকে দমন করে স্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে (২)। এটি প্রাথমিক ভাবে সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণের শর্ত হিসেবে ভূমিকা পালন করে। কিন্তু একটি সমাজ বা রাষ্ট্রের স্থিতিস্থাপক সভ্যতা নির্মাণের পেছনে নিছক সংঘবদ্ধতাই যথেষ্ট না। বরং সংঘবদ্ধতার স্থায়িত্ব লাগবে; কেননা অস্থায়ী এবং যাযাবর সমাজের সভ্যতা গড়ে উঠে নি ইতিহাসে, তারা সবসময়ই স্থানিক পরিবর্তনশীলতার কারণে সভ্যতার নির্দিষ্ট ও শক্তিশালী কাঠামো তৈরি করতে পারে নি। ইবনে খলদুনের ‘মরুবাসি যাযবর‘রা যে-রকম শক্তিশালী সমাজকাঠামো তৈরি করেছিল, তাতে ভূমির স্থায়িত্ব না থাকলেও আসাবিয়াত (সামাজিক সংহতি) সামাজিক সম্পর্ককে তীব্র করেছিল, যা বেদুঈনদের রাষ্ট্রের প্রধান পাটাতন হিসেবে হাজির ছিল। সুতরাং স্থায়ী সংঘবদ্ধতার পাশাপাশি ‘আসাবিয়াত বা সামাজিক সংহতি’ও সভ্যতার একটি বুনিয়াদ; তবে এটি অবশ্যই হাদিসে বর্ণিত নিষিদ্ধ আসাবিয়াত তথা: অন্ধ গোত্রপ্রীতি না।বরং এটি এক ধরনের সোসাল কন্ট্রাক্ট।
তৃতীয়তঃ “Islam between east and west” বইয়ে culture এবং civilization নিয়ে আলিয়া আলি ইজেতবেগোভিচের গোটা আলাপের সারমর্ম হচ্ছে, 'সংষ্কৃতির বাহক মানুষ, সভ্যতার বাহক সমাজ।' এবং 'সংষ্কৃতির সম্পর্ক রুহানিয়াত ও পরকালের সাথে আর সভ্যতার সম্পর্ক ইহ-জাগতিকতার সাথে। এজন্য বিগত শতক থেকে চলে আসা ক্লাশ অব সিভিলাইজেশনে আলিয়া আলির প্রস্তাব ছিল, 'সভ্যতার মধ্যে এমন কোন ধনাত্মক শক্তি নেই যা সভ্যতার সকল অবিচলতা ও অসামঞ্জস্য মোকাবেলা করতে পারে (৩)। আদতে গিডেন্সের ভাষায় উত্তরাধুনিকতাও এক কিসিমের আধুনিকতা, আধুনিকতার ভেতরের প্রগতিশীল আধুনিকতা, আধুনিকতার মোকাবিলা যেমন উত্তরাধুনিকতা দিয়ে সম্ভব না ; তেমনি সভ্যতার অসুখ সভ্যতার ভিতরকার কোন ওষুধ দিয়ে চিকিৎসাযোগ্য নয়, একে সভ্যতার বাইরে থেকে চিকিৎসা করাতে হবে। এবং এটা পারে একমাত্র সংষ্কৃতি। এজন্য স্নায়ুযুদ্ধের অন্তিমকালে এসে, ১৯৭৯ সালে যখন ইরান-বিপ্লব সংগঠিত হল; যেখানে একটি জাতির 'রাজনৈতিক অভিভাবকত্ব' একজন রুহানি লোকের হাতে সমর্পিত হল, তখন স্বভাবতই মিশেল ফুকোর মতো কিছু পশ্চিমা তাত্ত্বিক গভীর পর্যবেক্ষণের মধ্যে দিয়ে দেখালেন 'রাজনৈতিক রুহানিয়াত' (political Spirituality)। তিনি নির্দেশ করলেন, পশ্চিম রাষ্ট্র ব্যবস্থায় গির্জাকে বর্জনের মধ্যে দিয়ে রুহানিয়াতের যে সংকট তৈরি করেছিল, সেটি এখনও অপূরণীয় রয়ে গেছে। সেই অপূর্ণতার কামালাতের প্রতিচ্ছবি ফুকো সন্ধান করলেন ইরান বিপ্লবের ভিতরে। সুতরাং পশ্চিমা সভ্যতার অসঙ্গতি, দুর্বলতা ও রুহানিয়াতের অভাব দূর করতে ইসলাম কিভাবে বিকল্প হিসেবে হাজির হতে পারে তা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে!
চতুর্থতঃ সভ্যতা ও সংস্কৃতির সংজ্ঞায়নে যেহেতু প্রতিটি জাতির নিজস্ব বিশ্বাস ও মূল্যবোধের প্রভাব থাকে, ফলত মুসলিম জাতির নিজস্ব পাটাতন থেকে পশ্চিমা সভ্যতার মোকাবেলা করতে হলে 'তুরাস'কে ভিত্তি হিসেবে হাজির করতে হবে। সভ্যতা (حضارة) এবং সংষ্কৃতির (ثقافة) সাথে আমাদের তুরাসের বুৎপত্তি এবং সংজ্ঞার্থে কি ধরনের সম্পর্ক, সেটা নির্মাণ করতে হবে আগে। আলিয়া আলির প্রস্তাবনা যথার্থ বিবেচনা করে, তার দেওয়া সংজ্ঞার্থকে যথাযথ স্থানে রেখে আমরা তুরাসের সঙ্গে সভ্যতা ও সংস্কৃতির কাঠামোগত বোঝাপড়া নির্মাণ করব। ইসলামি তুরাসের পাটাতন থেকে লক্ষ্য করলে দেখবেন যে, সভ্যতা (حضارة) এবং সংষ্কৃতি (ثقافة) আদতে ইসলামি ঐতিহ্যের-ই (تراث ) দুটি ভিন্ন ভিন্ন অংশ (৪)। এজন্য মুসলিম ঐতিহ্যে গির্জার মতো নিছক সংষ্কৃতি এবং গ্রিক ও পশ্চিমা সিলসিলার মতো শুধু সভ্যতা-সংশ্লিষ্ট হওয়ার ইতিহাস নেই। তুরাসের অগ্রযাত্রা সবসময়ই সভ্যতা ও সংস্কৃতির সমন্বয়ে বেড়ে ও গড়ে উঠেছে। সুতরাং, সামনের আলাপে সভ্যতার সংকট নিয়ে 'তুরাসের' পাটাতন থেকে আমরা ওয়েস্টার্ন সিভিলাইজেশন এবং ক্রিস্টিয়ানিটির ক্রিটিক করব বেশকিছু নোক্তার মাধ্যমে ; এর মধ্যে দিয়ে পষ্ট হবে, ঠিক কি কারণে ইসলাম 'সভ্যতার দ্বন্দ্বে' প্রধান এবং সফল ভূমিকা পালন করতে সক্ষম এবং ইসলামের এই সক্ষমতা যেসব ধর্মাচরণ ও মূল্যবোধের যোগসাজশে বিকশিত হয়েছে, সেদিকেও ইশারা করব।

পাশ্চাত্য ও খৃষ্টবাদের সংকট :
প্রথমতঃ পশ্চিমা সভ্যতার সবচে গুরুতর সংকট হচ্ছে বস্তুবাদীতা। জগত এবং মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ক নিয়ে তাদের সকল আলাপের কেন্দ্রীয় চরিত্র থাকে বস্তুবাদ। পশ্চিমা সভ্যতায় মানুষ জগতের প্রভূ কিন্তু ইসলামি চিন্তায় মানুষ দুনিয়ায় আল্লাহর খলিফা। এজন্য পশ্চিমা সভ্যতার ব্যক্তিসত্তা পরম স্বাধীনতায় বিশ্বাসী; কোন শরিয়তের অধীনতা মানে না, হালালকে হারাম হারামকে হালাল বানানোর পূর্ণ-অথরিটির দাবি করে সুদের মতো বর্বর নীতিকে তারা আইনগত স্বীকৃতি দিয়েছে। বিপরীতে ইসলামি বিশ্বাসের ব্যক্তিসত্তা শরিয়তের আজ্ঞাবহ। এজন্য দেখবেন, স্রষ্টা সম্পর্কে গ্রীক-দার্শনিক এরিস্টটল মনে করতো, স্রষ্টা আদিকারণ; প্রথম কারণও তিনি সৃষ্টি করেছেন, কিন্তু জগতের পরবর্তী ঘটনা-দূর্ঘটনায় স্রষ্টার কোন হাত নেই। এখান থেকেই পাশ্চাত্যের আধুনিক সভ্যতার ভিত্তি রচিত হয়েছে। বিপরীতে ইসলামি সভ্যতায় স্রষ্টা সর্বশক্তিমান; পৃথিবীর ছোট বড়ো সকল ঘটনা তাঁর কর্তৃত্বের অধীনে।
গ্রিক ফিলোসফি এবং পশ্চিমা সভ্যতার সংযোগ নির্মিত হবার আগে, মধ্যবর্তী সময়ে সাময়িকভাবে ক্রিস্টিয়ানিটি একধরনের রুহানিয়াত বহন করলেও, বিজিত রাষ্ট্রে সে রুহানিয়াতের সম্প্রসারণ তারা ঘটাতে পারে নি। এখানে ঐতিহাসিক বাস্তবতা হচ্ছে, খৃষ্টবাদ যে অঞ্চল বা রাষ্ট্র-ই দখল করেছে, সেখানের সভ্যতা ও সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। আর মুসলিমগন যেসব অঞ্চল ও রাষ্ট্র বিজয় করেছে, ইসলাম সেখানের সভ্যতা ও সংস্কৃতির উপর প্রভাব বিস্তার করেছে। এজন্য খৃষ্টবাদ পশ্চিমা সভ্যতাকে রুহানি প্রেরণায় উৎসাহিত করার বদলে নিজেরাই বস্তুবাদী হয়ে উঠেছে। এবং এর প্রতিক্রিয়া হিসাবে জন্ম নিয়েছে সেকুলারিজমের। 'কায়সারের (রাষ্ট্রের) অংশ কায়সারকে দাও, স্রষ্টার হিসসা স্রষ্টাকে দাও' - খৃষ্টবাদের এই বহুল প্রচলিত বাক্য আদতে এরিস্টটলের প্রতিধ্বনি; এরিস্টটল বলতো, জগতের সঙ্গে স্রষ্টার কোন সম্পর্ক নেই। তাছাড়া ‘নিউ টেষ্টামেন্ট বা নতুন নিয়ম’ পাঠ করলে দেখবেন এখানে রাষ্ট্র-প্রশ্নকে খুব কমই হাযির করা হয়েছে। ঈসা আ. এর উত্থান পরবর্তী তিনশ বছরে খৃস্ট্রীয় সমাজ রাষ্ট্রের ব্যাপারে নির্মোহ ছিল। ফলাফলের বিচারে খৃস্ট্রধর্ম হচ্ছে একটি সামাজিক সংষ্কারধর্মী আন্দোলন, দয়া ,মানবতা ও আত্মিক অগ্রগতি যার প্রতিপাদ্য।
দ্বিতীয়তঃ বস্তুবাদীতা ছাড়াও পশ্চিমের বড়ো একটা সংকট 'বর্ণবাদীতা'। প্রাচীন গ্রিসের দার্শনিকরা মনে করতো, গণতন্ত্রের প্রবর্তন করেছে তারা। এবং নেতৃত্বস্থানীয় ও শাসকশ্রেণী ব্যতিত অন্যদের গণতান্ত্রিক অধিকার ভোগ করার অধিকার নেই, কারণ তারা বর্বর। রোমানরা শাসিতদের প্রতি এতোটাই বর্ণবাদী ছিল যে, অ-রোমকদেরকে রোমান আইনের অধীনে শাসিত হবার যোগ্য মনে করতো না। এখান থেকেই জোসেফ শাখতের প্রসিদ্ধ অনুমান যে, ইসলামি আইন রোমান আইনের উত্তরাধিকার; কেননা শাম অঞ্চলে রোমান আইনের অনুশীলন ছিল, পরবর্তীতে মুসলিমরা সিরিয়া জয়ের পর রোমান আইন দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। আদতে এই বক্তব্যের কোন ভিত্তি নেই। কারণ মুসলিম বিজয়ের পূর্বে সিরিয়ায় রোমান আইনের চর্চা ছিল না। সুফি আবু তালিব তাঁর লিখিত বিভিন্ন রচনায় দেখিয়েছেন, রোমান আইনের অনুবাদ সম্পন্ন হয়েছে মুলত ইসলামি ফিকহ সংকলনের অনেক পরে। এবং সিরিয়ায় মুসলিম শাসনের আগে রোমান আইনের চর্চা ছিল না (৫)।
আধুনিক পশ্চিমা সভ্যতায় এই বর্ণবাদী প্রবণতা সমান্তরালে হাজির আছে। জার্মানের হিটলারি নির্যাতন, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ এবং ইসরাইল কর্তৃক ফিলিস্তিনিদের উপর যে নির্যাতন জারি আছে, তার পেছনেও তাত্ত্বিক ভিত্তি তৈরি করেছে সেমেটিসিজম এবং অপরের ধারণা। তেমনি ফুকোয়ামা যখন বলছেন, ”পশ্চিমা সভ্যতা এবং উদার লিবারেলিজম ইতিহাসের পরিসমাপ্তি” তখন তিনি আদতে বর্ণবাদের-ই বিস্তার ঘটাচ্ছেন। এদিকে জাজিরাতুল আরব যখন উপনিবেশিক শাসনের অধীনে আসে, কার্ল মার্ক্স তখন আনন্দিত হয়েছিলেন এ হিসেবে যে, পশ্চাৎপদতা দুর হতে যাচ্ছে। এভাবে বর্ণবাদ বিকশিত হয়েছে মার্কসীয় চিন্তায়ও।
তৃতীয়তঃ দ্বান্দ্বিকতা পশ্চিমা সভ্যতার আরেকটি সংকট; এর সিলসিলা আরম্ভ হয়েছে 'ডারউইনীয় বিবর্তনবাদ' থেকে, যেখানে সৃষ্টিতে উৎকৃষ্টের নির্বাচন ও অযোগ্যের পতন হিসেবে নির্মাণ করা হয়েছে সৃষ্টিতত্ত্বকে। অন্যদিকে হেগেলের দ্বন্দতত্ত্বে প্রতিটি জিনিসের মধ্যে সংঘাত ও বৈপরীত্য হাজির হয়েছে, এই পাটাতনে দাঁড়িয়ে কার্ল মার্ক্স নির্মাণ করছেন সমাজের দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়া। আদিম সাম্যবাদী সমাজ, কৃষিসমাজ, দাস ব্যবস্থা, সামন্ততন্ত্র এবং জমিদারপ্রথা হয়ে সভ্যতা আজ প্রবেশ করেছে পুজিঁবাদি বিশ্ব ব্যবস্থায়, মার্ক্সীয় বিশ্ববীখ্যার দাবি হচ্ছে জগতের চিরায়ত দ্বন্দ্বের ধারাবাহিক প্রচেষ্টা হিসেবে আগামী বিশ্ব হবে সাম্যবাদী। এসব প্রক্রিয়ায় একটা বৈশিষ্ট্য দেখা যাচ্ছে, তা হল, নতুন পুরাতনকে বাতিল করছে। প্রগতিশীলতার জয় হচ্ছে পশ্চাৎপদতার উপর।
ওয়ায়েল হাল্লাক পশ্চিমের এই প্রগতির ধারণাকে বলেছেন “Theology of progress”। এটি প্রগতির এক সরল রৈখিক ধারণায় বিশ্বাস করে । অতীতে যা ছিল, তা পশ্চাৎপদ । সুন্দর যা কিছু, তা সমুখে । কৃষিভিত্তিক জীবনের চেয়ে নগর ও শিল্পায়িত জীবন প্রগতিশীল । এইভাবে সে একটা এথিক্সও তৈরি করে। প্রগতির এই ধারণা বিশ্বাস করে এক অনাগত সুন্দর ভবিষ্যতে যা বর্তমানের চেয়েও উত্তম। এই প্রগতি নিছক বস্তুগত ক্ষেত্রেই না বরং ধর্ম, নৈতিকতা, চিন্তা ও আচরণেও। বিপরীতে ইসলামে আছে 'খাইরুল কুরুন' এর ধারণা। এটাকে হাল্লাক বলছেন "Theology of ethical reversion"; যা পশ্চিমা প্রগতির বিপরীতে তাকায় অতীতের দিকে৷ নবি ও সাহাবাগণের প্রথম তিন প্রজন্ম হচ্ছেন খাইরুল কুরুন। ইসলামে "অতীত" নৈতিকভাবে অনুসরণীয় এক মানহাজ। তবে এই তাকানোর রুহানি গুরুত্বটাই বেশি প্রাসঙ্গিক (৬)। আমরা মনে করি ইসলাম, নৈতিকতা, চিন্তা ও আচরণে আমরা সালাফদের কাছে দায়বদ্ধ; সামনে যে জনগোষ্ঠী আসবে নীতি-নৈতিকতার দিক থেকে তারা হবে আরো বেশি অধঃপতিত। ইসলামি চিন্তায় বৈষয়িক ক্ষেত্রে প্রগতি হতে পারে, কিন্তু ধর্ম ও বিশ্বাসে তা অসম্ভব।
উপসংহৃতি/ খাতেমা:
সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা শেষে কয়েকটি অনুসিদ্ধান্তে হাজির হওয়া যায়; প্রথমত, ইসলামি সভ্যতা ‘বৈশ্বিক’ বা আলমি (গ্লোবাল)। এতে আঞ্চলিক গোঁড়ামি, জাতিবাদ এবং বর্ণবাদের সংকীর্ণতা নেই। এজন্য কুরআনে সমগ্র জাহানের প্রতি বৈশ্বিক আহবান রয়েছে; রাব্বুল আলামিন, হুদা লিল আলামিন (বিশ্ববাসীর জন্য পথপ্রদর্শন), এবং নাযিরুন লিল আলামিন (জগতবাসীর জন্য ভীতি-প্রদর্শক) এইসব আয়াত ইসলামি সভ্যতার ’বৈশ্বিক’ হবার প্রতি নির্দেশ করে। ولَقْد َ كرْمنا َبنِي َآدَم বলে আল্লাহ তায়ালা মনুষ্যত্বের মর্যাদা তুলে ধরেছেন, নির্দিষ্ট জাতি, বর্ণ বা ভাষাভাষিদের না (৭)। দ্বিতীয়ত, ইসলামি সভ্যতায় রাজনীতি ক্ষমতা প্রয়োগের নাম না; বরং নীতি-নৈতিকতা, কল্যাণ ও স্থিতিশীল সমাজ তৈরির যৌথ-ব্যবস্থাপনা; যেখানে আমজনতা এবং শাসকশ্রেণী একযোগে ভুমিকা পালন করবে। তৃতীয়ত, ’তমুদ্দুনিক বিচ্ছিন্নতা’ (alienation) সমকালীন মুসলিমদের একটি মৌলিক সমস্যা (৮)। কোন ব্যক্তির আত্মপরিচয় ভুলে যাওয়া বা নিজের সাথে অপরিচিত হয়ে উঠা কিংবা নিজের প্রতি উদাসীন হয়ে উঠার প্রক্রিয়াকে বিচ্ছিন্নতা বলে। এর ফলে ব্যক্তি অন্যের চিন্তা-ভাবনা দ্বারা নিজস্ব মতামত গঠন করে। সাংস্কৃতিক বিচ্ছন্নতা হচ্ছে, আমি যখন নিজের ধর্ম, সাহিত্য, আবেগ, প্রয়োজন ও বেদনাকে নিজস্ব সংস্কৃতির আলোকে অনুভব না করে সেখানে ভিন্ন আরেকটি সমাজের সংষ্কৃতিকে কল্পনা করি। এমন কিছু সংকট নিয়ে বিলাপ করি যেগুলো আদতে আমার নয়। আমি এমনকিছু আদর্শ ও বেদনা লালন করি যা আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ভাবে ভিন্ন পরিস্থিতির, ভিন্ন সমাজের। এভাবে আমাদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা শুরু হয়। এভাবে উপনিবেশের সময় থেকে মুসলিম বিশ্বের সমাজগুলো ইউরোপীয় সমাজ দ্বারা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে; অত্যন্ত হাস্যকরভাবে চরম দারিদ্র, ঈমানহীনতা ও অস্থিরতার মধ্যেও মুসলিমরা আমেরিকান, ব্রিটিশ বা ফরাসিদের মতো আকাঙ্খা ও আচরণ জাহির করছে। দিনশেষে তারা ভিন্ন ভিন্ন অংশের জোড়াতালি লাগিয়ে একটা কাঠামোবিহীন সমাজ নির্র্মাণ করতেছে যার কোন লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নেই । ফলে আমাদের সভ্যতা-সংষ্কৃতিতে সবকিছু থেকেই কিছু না কিছু আছে; কিছু স্থানীয়, কিছু ইউরোপীয়, কিছু প্রাচীন কিছু আধুনিক। এভাবে আমরা আমাদের আত্মপরিচয় হারিয়ে বসেছি। চতুর্থত, আমরা মনে করি, ইসলাম, নৈতিকতা, চিন্তা ও আচরণে আমরা সালাফদের কাছে দায়বদ্ধ; সামনে যে জনগোষ্ঠী, কেয়ামত যত ঘনিয়ে আসবে নীতি-নৈতিকতা এবং ধার্মিকতার দিক থেকে মানুষ হবে আরো বেশি অধঃপতিত। রাসুল সা. বলেন, (খাইরুল কুরুনি কারনি ছুম্মাল্লাযিনা ইয়ালুনাহুম, ছুম্মাল্লাযিনা ইয়ালুনাহুম) ”আমার যুগ সর্বশ্রেষ্ঠ অতঃপর পরের যুগ, তারপর তারপরের যুগ” (৯)। ইসলামি চিন্তায় বৈষয়িক ক্ষেত্রে প্রগতি হতে পারে, কিন্তু ধর্ম, আখলাক ও বিশ্বাসে সাহাবা যুগই সর্বৎকৃষ্ট।
খালিদ মুহাম্মাদ সাইফুল্লাহ
ফেলো, সেন্টার ফর অল্টারনেটিভ ডেভেলপমেন্ট ট্রাস্ট (সিএডিটি)
সূত্র-নির্দেশ:
১ . আবুল মনসুর আহমদ, বাংলাদেশের কালচার, ৪ পৃ
২. ইবনে খালদুন, মুকাদ্দিমা, ৪৫ পৃষ্ঠা
৩. Alia Ali, Islam between East and West p.35
৪. ত্বোহা আব্দুর রহমান, তাজদিদুল মানহাজ ফি তাকয়িমিত তুরাস, ৮৬ পৃ
৫. মুহাম্মাদ ইমারা, রুয়াতুন নাকদিয়া বাইনাল হাযারাতিল গারবিয়া ওয়াল ইসলামিয়া, ৪ পৃ
৬. waell hallaq , Reforming Modernity: Ethics and the New Human in the Philosophy of Abdurrahman Taha , 13
৭. সুরা বানী ইসরাইল, আয়াত- ৭০
৮. আলি শরিয়তি, সভ্যতা ও আধুনিকায়ন, ৩ পৃষ্ঠা
৯. সহিহ বুখারী, হাদিস নং. ৬৬৯৫
コメント