শিশু জীবনে পরিপার্শ্বের প্রভাব:আগামীর দিনলিপি
- খালিদ মুহাম্মাদ সাইফুল্লাহ
- Sep 29, 2022
- 4 min read
Updated: Oct 17, 2022
আপনাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, সবচেয়ে সুক্ষ জিনিস কি ? আমি হয়তো আলো-বাতাসের কথা বলবেন; কেননা খুব সহজে, বিনা-বাধায় এটি বিচরণ করতে পারে। কিন্তু আলো-বাতাসের চেয়েও সুক্ষ জিনিস প্রতিনিয়ত আমাদের জীবনে আসে, বাঁধাহীন, সবার অগোচরে নাড়িয়ে দিয়ে যায় আমাদের বোধ ও বিশ্বাস ! কি সেটা, জানেন ? প্রভাব পৃথিবীর সবচে সুক্ষ জিনিস হচ্ছে প্রভাব। আপনি হয়তো হাতে কলমে আলো-বাতাসের অস্তিত্ত্ব, বিচরণ ও রুপ-প্রকৃতি দেখাতে পারবেন, কিন্তু প্রভাবকে দেখানো খুব মুশকিল। মানুষ জীবনে কতো কিছু দ্বারা প্রভাবিত হয় নিজেও বুঝে উঠতে পারে না। যেমন ধরেন, গত সপ্তাহে আমি একটা বই পড়েছি। বইটা শেষ করে নিজের শেলফে যথাস্থানে রেখে দিয়েছি। কিন্তু সেখানে এমন কিছু শব্দ ছিল, কথা ছিল যা আমি ভুলতে পারছি না। ওরা আমার সত্তার গভীরে এমনভাবে জেঁকে বসেছে যে আমি নিজের থেকে ওদের আলাদা করতে পারছি না। সাথে সাথে আমি খেয়াল করলাম কথাগুলোর সাথে আমার পরিচয় হবার ফলে আমার মধ্যে এক ধরনের পরিবর্তন ঘটছে। বহু বছর পর হয়তো বইটির কথা আমি বেমালুম ভুলে যাবো, শব্দগুলোও ঠিকঠাক মনে থাকবে না, কিন্তু তা সত্ত্বেও আমি কিন্তু আর আগের আমি নাই। সামান্য হলেও বদলে গেছি। এই অন্তর্নিহীত শক্তিকে কি দিয়ে ব্যাখ্যা করবেন ?

প্রভাবের মধ্যে একটা দুর্দান্ত ক্ষমতা আছে, মানুষের ভেতরের অন্ধকারকে পরম আলোয় উদ্ভাসিত যেমন করে, তেমনি একটা নির্মল ও কোমল মানুষের অন্তরাত্মাকে ক্রমশ বিদুষিত করে দেয়। হাদিসে আসছে, প্রতিটি শিশু স্বভাবজাত স্বাভাবিকতা নিয়ে জন্মায়, অতঃপর তার বাবা-মা (পরিবেশ ও প্রতিপার্শ্ব) তাকে ইহুদি বানায় অথবা খৃষ্টান। আমাকে মনে রাখতে হবে, প্রতিটি সদ্য-ভূমিষ্ঠ সন্তান-ই অজস্র সুপ্ত-অচেনা সম্ভাবনার চেরাগ নিয়ে দুনিয়ায় আসে — ওরা কেবল একটু ঘুমভাঙানিয়া পরশ, একটু কথা, মৃদু আঘাতের প্রতীক্ষায় উন্মুখ। সেই ঘুমভাঙানিয়া পরশ পেলে সে জ্বলে উঠবে, পৃথিবীকেও আলোকিত করবে।
প্রভাবের দুই ধরনের প্রকাশ আছে — বৈশ্বিক এবং স্থানিক। বৈশ্বিক প্রভাব একই সময়ে পরিবার, শহর এবং গোটা দেশের জীবনানুভূতিকে স্পর্শ করে, আর স্থানিক প্রভাব সীমায়িত থাকে তার বলয়ের মধ্যে। বিশ্বায়নের যুগে শিশ, ছাত্র ও সন্তানাদির জীবন গঠনে কেবল ঘরোয়া পরিবেশের দিকে নজর দিলেই চলবে না, বাইরের প্রভাবের দিকেও মনোযোগী হতে হবে। একটি নিখাদ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা গ্রহণ করেও একটি ছেলে পশ্চিমা মূল্যবোধ ও ভাবধারায় অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারে। জীবন দিয়ে দিতে পারে ভিনদেশী সংষ্কৃতি জন্য। হিজাব পড়েও দাঁড়াতে পারে হিজাববিরোধী শ্লোগানে। সম্প্রতি ইরানের মাহসা আমিনিকে ঘিরে সৃষ্টি হওয়া হিজাববিরোধী মুভমেন্ট সেটাই দেখাচ্ছে — একটা আগাগোড়া ধর্মীয় অনুশাসনে পরিবেষ্টিত জনগোষ্ঠী কিভাবে অন্যের ভাষায় কথা বলতেছে, নিজেদের ভাষা ও চেতনা ভুলে গিয়েছে। এর মানে বাইরের পথ বন্ধ করে দিব, চার দেওয়ালের মধ্যে আবদ্ধ করে ফেলবো তা না, বরং আমি বলছি বাইরের প্রভাবের চেয়ে ভেতরের প্রভাব অনেক বেশি শক্ত করতে হবে, ঘর ও পরিবার পরিজনের হেদায়েত মজবুত থাকতে হবে। শ্রদ্ধাভাজন এক মুরুব্বীকে জিজ্ঞাসা করা হলো, আচ্ছা ! আগে তো মাদরাসা এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান কম ছিল তুলনামুলক, এখন তো বিপুল ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, অথচ আগের তুলনায় এখনকার মানুষ বেশি অনৈতিক, অধার্মিক এবং অসত। জবাবে তিনি বললেন, না ! ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান আগের তুলনায় কমে গেছে। আজব তো ! কিভাবে ? বললেন, দেখো, আগে একটা শিশু যার কোলে যেত, সেই একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা পালন করতো। বাবা, মা, ভাইবোন এবং পাড়া-প্রতিবেশী সবার থেকেই শেখার ব্যবস্থা ছিল। ফলে ঘরের ভেতরেই গোটা দশেক প্রতিষ্ঠান হাজির থাকতো । অথচ এখন একজন বাবা-মা নিজে না শিখিয়ে অপেক্ষায় থাকে প্রতিষ্ঠানের। চেয়ে থাকে শিক্ষকের দিকে।
একটা কথা মনে রাখতে হবে, মানুষ দুনিয়াতে একবার-ই আসে। বয়সের বিভিন্ন ধাপ অতিক্রম করে একসময় সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। শিশুকাল হলো তাকলিদ বা অনুকরণের সময়, যৌবন দেখে শুনে শেখার সময় এবং বার্ধক্য হচ্ছে ব্যয় করার সময়। শিশুকালে যা শিখবে তাই বৃদ্ধ বয়সে পরবর্তী প্রজন্মকে শিক্ষা দেবে। শিশুদের সঙ্গে একটা সময় পর্যন্ত আমি নিজেও দুষ্টুমি করতাম। অযথা খোঁচাখুঁচি করে মজা পাইতাম। এখন খুব সচেতনভাবে এড়িয়ে চলি। প্রতিটি শিশুর সামনে বয়স্করা কেতাবের মত হাজির থাকে। খোঁচাখুঁচি একটি শিশুর সুস্থ মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে 'প্রহারের' চেয়েও নিকৃষ্ট প্রভাব ফেলে। বেআদব এবং দুষ্ট প্রকৃতির হয়ে উঠে সে। ইবনে খলদুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং পরিবারে একটা শিশুর বেড়ে উঠার সঙ্গে সভ্যতার সম্বন্ধ নিয়ে আলাপ করেন। নিতান্ত চাপবোধ, প্রহার-প্রবন পরিবেশে মানুষ কপটতা শেখে, ধোঁকা এবং মিথ্যার আশ্রয় খোঁজে। শিশুর ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম না। আজকের শিশু পরবর্তী সমাজে নীতি-নির্ধারণীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে। তাদের মিথ্যুক, মেকিআশ্রিত এবং অসভ্য হতে দিবেন না। পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মারমূখী আচরণ কমিয়ে আনতে হবে। জুলুমতন্ত্র, আবদ্ধ ও চাপা পরিবেশে বেড়ে ওঠা সমাজ নেতৃত্বের প্রতিভা হারিয়ে ফেলে। নিস্তেজ হয়ে যায় অদম্য সাহসিকতা। খলদুন বলেন, কিবতী সম্প্রদায়ের 'ফেরাউনী' জুলুমে বনী ঈসরাইল হীনমন্য হয়ে গেছিল। আপাতত ভীতু টাইপের সম্প্রদায় দিয়ে আমালেকা গোত্রের সঙ্গে বিজয় সম্ভব ছিল না, এজন্য আল্লাহ তা‘আলা বনী ইসরাইলকে 'তীহ প্রান্তরে' কয়েক যুগ ঘুরপাক খাইয়ে ভীতু সম্প্রদায়ের নাশ ঘটিয়েছেন। সৃষ্টি করেছেন স্বাধীন ও মুক্ত আবহের নবপ্রজন্মকে; তাদের হাতেই গড়ে উঠেছিল ইসরাইলিদের রাষ্ট্র এবং শক্তিশালী সভ্যতা।
দুনিয়া খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছে, আগের দশকের অভিজ্ঞতা পরের দশকে কাজে লাগছে না। এটা অবশ্যই এই উম্মতের জন্য ভয়াবহ ঘটনা। এর ফলে আগের প্রজন্মের মানুষের সাথে নতুন প্রজন্মের যোগাযোগ কমে যাচ্ছে, নতুনরা পুরাতনদের অভিজ্ঞতাকে সেকেলে ভাবতে শুরু করছে, লাগামহীন হয়ে যাচ্ছে এ সমাজ। এক্ষেত্রে আমাদের বয়স্করা গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা না রাখতে পারলে উম্মাহ একটা নিঃসীম খাদে পড়ে যাবে। সমস্যা হচ্ছে — আমরা বড়রা নিজেদের শৈশবের সকল অভিজ্ঞতাকে আজকের শিশুর উপর প্রয়োগ করতে চাই, যা নতুনদের কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত ও অনুপুযোগী মনে হচ্ছে। ফলে সব বিষয়ে নতুনরা বয়স্কদের এড়িয়ে চলতে শুরু করেছে। আমার এক চাচাতো ভাই, বছরতিন আগে হাইস্কুলে পড়ত, বয়স ছিল পনেরো। তার বাবার বয়স আনুমানিক ৪৫ হবে। খুব বেশি দূরত্ব নেই তাদের মাঝে। একদিন দেখলাম টিউটর নিয়ে তাদের মধ্যে মৃদু রেষারেষি হচ্ছে। আলাপচারিতায় বুঝলাম, বাবা চাচ্ছেন নিজের শৈশবের শিক্ষকের কাছে তার ছেলেকে পড়াবেন, কেননা বাবার অভিজ্ঞতায় উনি সেরা শিক্ষক। কিন্তু ছেলে বলতেছে পড়াশোনার প্যাটার্ণে পরিবর্তন আসছে, সিলেবাসে আইসিটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, ফলে পুরাতন শিক্ষকগন আগের মতো পড়াতে পারছেন না। এই ঘটনা বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে — আমি এই ঘটনায় দ্বিমুখী সংকট দেখতে পেলাম, একদিকে নতুনদের বয়স্কদের থেকে বিচ্ছন্ন হয়ে যাওয়া নতুবা পরিবর্তনের প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে থাকা। এটি বড় একটি সংকট যার সুরাহা দরকার। এটা শুধু শিক্ষণপ্রক্রিয়ায় না বরং জীবনের সব দিকে।
পরিশেষে একটা কথা বলি, আমরা বর্তমানে যে পরিবেশে বাস করতেছি, তা কিন্তু আমাদের তৈরি করা না, বরং আমাদের পূর্বপুরুষরা যেভাবে রেখে গেছেন, সেখানেই আমরা বেড়ে উঠছি। আমরা যেমন পূর্ববর্তী প্রজন্ম নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে কথা বলি, পরবর্তীরাও আমাদের নিয়ে কথা বলবে। আজকে যে শিশুটি জন্ম নিল সে যে একটা কপট, অসৎ ও অশ্লিল দুনিয়ার সাথে পরিচিত হবে, তার দায় তো আমাদেরই। আমরা কেন তাকে পবিত্র পরিবেশ দিতে পারলাম না। আমরা যেন দুনিয়াকে একটা নির্মল আবহে রেখে যেতে পারি, স্বভাবজাত স্বাভাবিকতা নিয়ে জন্মানো একটা শিশু যেন আমাদের পঙ্কিলতায় নষ্ট না হয়, সেই পদক্ষেপ নিতে হবে। শিশু আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাদের হাতে তুলে দেওয়া আমানত; তার স্বভাবজাত স্বাভাবিকতা নষ্ট না করে তুলনামুলক উত্তম পৃথিবীর জন্য তাকে প্রস্তুত করে দিতে হবে।
Comments